পবিপ্রবি প্রতিনিধি: পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়—দক্ষিণ বঙ্গের ক্যামব্রিজ খ্যাত এই সবুজাভ প্রাঙ্গণ শুধু ইট-গাছ-নদীর মিলন নয়, এটি অসংখ্য স্বপ্ন, হাসি-কান্না ও বন্ধুত্বের গল্পে ভরা এক জীবন্ত কাব্যগ্রন্থ। ১৪ আগস্ট- ২০২৫, তারিখটি পবিপ্রবির ইতিহাসে সোনালী অক্ষরে লেখা থাকবে। সেদিন ছিল বিদায়ী শিক্ষার্থীদের জন্য এক অনন্য দিন—যেদিন আনন্দ, সুর আর স্মৃতির বর্ণিল মিলনে ভরে উঠেছিল ১২০ একরের বিস্তীর্ণ এই ক্যাম্পাস।
শুরুটা শোভাযাত্রা—বিদায়ের প্রথম রঙিন অধ্যায়: হৃদয়ে উচ্ছ্বাসের ঢেউ: ব্যাবসায় প্রশাসন অনুষদ, সিএসই ও আইন অনুষদের শিক্ষা সমাপনী উৎসবের প্রথম পর্ব শুরু হয় সকাল ১০টায় বর্ণিল শোভাযাত্রার মাধ্যমে। সাদা টি শার্ট পড়া, হাতে ব্যানার, মাথায় টুপি, কারো গলায় গিটার, কারো হাতে রঙিন পতাকা—সব মিলিয়ে যেন আনন্দের নদী বয়ে চলল পুরো ক্যাম্পাসজুড়ে। শোভাযাত্রা টিএসসির সামনে এসে শেষ হয়, আর সেখানেই শুরু হয় ভাইস-চ্যান্সেলর প্রফেসর ড. কাজী রফিকুল ইসলাম এর হাত দিয়ে কেক কাটা এবং পরে তা খেয়ে বিদায়ের মিষ্টি মুহূর্ত।
প্রধান অতিথি ভাইস-চ্যান্সেলর বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও গবেষক প্রফেসর ড. কাজী রফিকুল ইসলাম বলেন, “আজ শুধু বিদায় নয়, এটি স্মৃতির এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা। এখানকার প্রতিটি মুহূর্ত, প্রতিটি বন্ধুত্ব, প্রতিটি শেখা—জীবনের প্রতিটি চ্যালেঞ্জে তোমাদের সাহস জোগাবে। শিক্ষার সঙ্গে আনন্দের এই মিলনই জীবনের আসল রঙ।”
বিশেষ অতিথি প্রো ভাইস-চ্যান্সেলর প্রফেসর ড. এস. এম. হেমায়েত জাহান, কোষাধ্যক্ষ প্রফেসর মোঃ আবদুল লতিফ এবং রেজিস্ট্রার প্রফেসর ড. মোঃ ইকতিয়ার উদ্দিন বলেন,
“একসাথে পথচলা, একসাথে হাসি-কান্না ভাগাভাগি—এই অনুভূতিগুলো কখনো মুছে যাবে না। এগুলো তোমাদের জীবনের ভাণ্ডারে চিরকাল রয়ে যাবে।”
বিদায়ের অনুভূতিতে শিক্ষক ও কর্মকর্তাদের স্নেহমাখা কথা:- বিদায়ী শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে যৌথ বার্তায় ছাত্র বিষয়ক উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মোঃ সুজাহাঙ্গীর কবির সরকার, সহকারী ছাত্র বিষয়ক উপদেষ্টা ড. মোঃ সগিরুল ইসলাম মজুমদার, ডেপুটি রেজিস্ট্রার মুহাম্মদ ইমাদুল হক প্রিন্স, সহকারী প্রক্টর ড. মুহাম্মদ ইকবাল হোসেন ও সহকারী রেজিস্ট্রার মোঃ আবু তাহের উজ্জ্বল বলেন, পবিপ্রবি শুধু একটি বিশ্ববিদ্যালয় নয়, এটি একটি পরিবার; যেখানে সাফল্যে আনন্দ আর ব্যর্থতায় সান্ত্বনা মেলে। এখানকার শিক্ষা, বন্ধুত্ব ও স্মৃতি হবে জীবনের অনন্ত পথের প্রেরণা। বিদায় মানে শেষ নয়, বরং নতুন যাত্রার সূচনা।
বেলা ১১টায় কেন্দ্রীয় খেলার মাঠে শুরু হয় ফ্লাশ মুভের উচ্ছ্বাসময় আয়োজন। পরবর্তী মুহূর্তে মাঠ প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে, যখন শুরু হয় অটোগ্রাফের আদান-প্রদান—প্রিয় বন্ধুদের স্বাক্ষর পেতে ছুটে আসে আনন্দমিশ্রিত ভিড়। তারপর আসে মাঠে কাদা মাখা মাখির অবিস্মরণীয় মুহূর্ত, যেখানে প্রতিটি ছোঁয়া, প্রতিটি হাঁসি, প্রতিটি উচ্ছ্বাস যেন মিলেমিশে একটি জীবন্ত ক্যানভাসে রূপ নেয়। মাঠের কোণাকুণে বাজে শিশিরের মতো উজ্জ্বল হাসি, উড়ছে কাদা-মাখার রঙিন ছিটে, আর উচ্ছ্বাসে নাচছে সময়ের প্রতিটি সেকেন্ড।
বিকেলের সুরের ভেলায়—লোকগানের মায়াজাল: বিকেল চারটায় আষাঢ়ের মেঘলা আকাশ, হালকা গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি আর মঞ্চের ঝলমলে আলো—সব মিলিয়ে যেন আয়োজন করছিল একটি স্বপ্নময় জগৎ। সেই মুহূর্তে শুরু হলো পবিপ্রবির দ্বিতীয় পর্বের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। শিক্ষার্থীদের নাচ, নাটক ও সুরের পরিবেশনার পর মঞ্চে ধীরে ধীরে উপস্থিত হলেন সেই প্রতীক্ষিত শিল্পীরা—ব্যান্ড “লালন”।
লালন ব্যান্ডের লাইনআপে ছিলেন: নিগার সুলতানা সুমি (লিড ভোকাল), থিন হান মং তিতি (ড্রামস), তাহজিব উর রশীদ (বেজ), আরাফাত বসুনিয়া (কী-বোর্ড), মহন্ত সরকার (গিটার), এবং শারুফ ইসলাম ফায়াস (হারমোনিক ভোকাল)।
জনপ্রিয় শিল্পী নিগার সুলতানা সুমি’র কণ্ঠে একে একে ভেসে এলো লালনের চিরস্মরণীয় গানগুলো—“সত্য বল সুপথে চল”, “জাত গেল জাত গেল বলে”, “মন আমার দেহঘড়ি”, “খাঁচার ভিতর অচিন পাখি”, এবং “এই পাগলের ভালোবাসাটুকু নিও”। প্রতিটি সুর যেন বিদায়ী শিক্ষার্থীদের মনকে আরও কোমল করল, আরও আবেগে ভরে তুলল। শোনার সঙ্গে সঙ্গে তাদের হৃদয়ে জমে উঠল এক ধরনের নস্টালজিয়া, আনন্দ আর বিদায়ের মিশ্র অনুভূতি—যা চিরকাল স্মৃতির পাতায় অমলিন হয়ে থাকবে। মঞ্চের প্রতিটি আঙিনায়, বাতাসে ভেসে আসা সুরে এবং দর্শকের হৃদয়ে—সব মিলিয়ে তৈরি হলো এক অনন্য আবহ, যেখানে সঙ্গীত আর অনুভূতির মেলবন্ধন হয়ে উঠল বিদায়ের সবচেয়ে মধুর স্মৃতি।
দর্শকের ঢল, ইতিহাসের রেকর্ড: ‘বিস্ময় ২০’-এর এ আয়োজনে শুধু শিক্ষার্থী নয়, আশেপাশের জেলার মানুষও ভিড় জমালেন। সেকেন্ড গেট পর্যন্ত ভিড়ের ঢল নেমে আসে, প্রশাসনকে নির্ধারিত সময়ের আগে অনুষ্ঠান শেষ করতে হয়। তবু আনন্দ, উচ্ছ্বাস আর সুরের আবেশে এই সমাগম পবিপ্রবির ইতিহাসে এক অনন্য রেকর্ড হয়ে রইল।
বিদায়ের শেষ আলো: রাত গড়িয়ে অনুষ্ঠান শেষ হলেও, মাঠে, আকাশে, আর মানুষের হৃদয়ে থেকে গেল লোকগানের প্রতিটি লাইন, প্রতিটি হাসি, প্রতিটি আলিঙ্গন। বিদায়ী শিক্ষার্থীরা ফিরে গেলেন বুকভরা স্মৃতি নিয়ে—যেখানে আছে বন্ধুত্বের রঙ, ভালোবাসার উষ্ণতা, আর কিছু না বলা কথার গভীরতা। এই দিনটি তাই শুধু একটি বিদায়ের দিন নয়—এটি ছিল প্রাণের মানুষেরা মিলে গড়া এক জীবন্ত কবিতা, যা প্রতিটি অংশগ্রহণকারীর হৃদয়ে চিরকাল অমলিন হয়ে থাকবে।