আবু নোমান ফারুক আহম্মেদ: সাম্প্রতিক সময়ে উচ্চমূল্যের সবজি উৎপাদনের ক্ষেত্রে অধিকাংশ কৃষকই হাইব্রিড জাত ব্যবহার করছেন। কৃষকের জন্য এসব হাইব্রিড বীজ উৎপাদন করার সূযোগ খুবই সীমিত। তাই তাদেরকে হাইব্রিড বীজের জন্য বীজ ব্যবসায়ীদের উপর নির্ভর করতে হয়। তথাপিও এখনো অনেক কৃষক দেশীয় উচ্চ ফলনশীল জাতের শাক সবজি চাষ করে থাকেন। বিশেষকরে প্রায় সকল শাকজাতীয় ফসলের বীজ কৃষকরাই উৎপাদন ও সংরক্ষন করে থাকে। উন্নতমানের বীজ উৎপাদন এবং সংরক্ষণ হচ্ছে ভাল ফসল উৎপাদনের পূর্বশর্ত। ফসলের জাত যতই ভাল হোক না কেন সজীব ও সতেজ বীজ ব্যবহার না করলে কাংখিত ফলন আশা করা যায় না। সুতরাং শাক সবজির ফলন বৃদ্ধির জন্য উন্নত মানের বীজের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। নিম্নে সবজি বীজ উৎপাদনের সহায়ক বিভিন্ন প্রয়োজনীয় কলাকৌশল সম্পর্কে আলোচনা করা হল:
সবজি ও সবজির জাত নির্বাচনঃ স্থানীয় পরিবেশে বীজ উৎপাদন করা যাবে এমন সবজি এবং ঐ সবজির ভাল জাত নির্বাচন করা উচিত।
ভিত্তি বীজ সংগ্রহঃ নির্ভরযোগ্য উৎস থেকে ভিত্তি বীজ সংগ্রহ করে বীজ উৎপাদন করতে হবে। ভিত্তি বীজ ব্যতিত অন্য কোন ধরনের বীজ দিয়ে বীজ উৎপাদন করলে বীজের গুণগতমান বজায় থাকবে না।
জমি নির্বাচনঃ সবজি বীজ উৎপাদনের জন্য জমি নির্বাচনের সময় নিম্নের বিষয়গুলে বিবেচনা করতে হবেঃ পর্যাপ্ত আলো বাতাস পায় এমন জমি, প্রচুর জৈব পদার্থ সমৃদ্ধ উর্বর দোআঁশ মাটি, নিস্কাশনের সুবিধা আছে এমন জমি।
আবাদ মৌসুম নির্ধারণঃ বীজ উৎপাদনের ক্ষেত্রে আবাদ মৌসুম এমনভাবে নির্ধারণ করতে হবে যাতে করে ঐ সময় উপযুক্ত আবহাওয়া বিরাজ করে।
জমি তৈরিকরণঃ ভালোভাবে কয়েকটি চাষ দিয়ে জমি সম্পূর্ন আগাছা মূক্ত করতে হবে। তারপর ঢেলা ভেঙ্গে মাটি নরম ও ঝুরঝুরে করে নিতে হবে। শেষ চাষের সময় জমিতে সার মিশাতে হবে।
সার প্রয়োগঃ বীজের গঠন, পরিপুষ্ঠি ও ফলন বৃদ্ধির জন্য ফসলের বিভিন্ন পর্যায়ে বিভিন্ন ধরনের খাদ্য উৎপাদনের প্রয়োজন হয় । কাজেই সময়মত সারের উপরি প্রয়োগ করতে হবে। বীজ উৎপাদনের ক্ষেত্রে ফসফরাস এবং পটাশিয়াম সার খুবই কার্যকর। আবাদ পদ্ধতিঃ বীজ ফসল অবশ্যই সঠিক দূরত্ব বজায় রেখে লাইন করে চাষাবাাদ করতে হবে।
আগাছা দমনঃ আগাছা ফসলের সাথে আলো-বাতাস এবং খাদ্য নিয়ে প্রতিযোগিতা করে এবং রোগ ও পোকার আবাসস্থল হিসাবে কাজ করে। তাই সময়মত আগাছা দমন করতে হবে। জমিতে আগাছা থাকলে বীজের চারিত্রিক গুণাবলী নষ্ট করে দিতে পারে।
সেচ-নিস্কাশন ব্যবস্থাঃ সেচ ও নিস্কাশন ব্যবস্থা বীজ ফসলের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মাটিতে পর্যাপ্ত রসের অভাব হলে গাছ ও বীজের স্বাভাবিক বৃদ্ধি ও পরিপুষ্টি বিঘ্নিত হয়। ফুলের পরাগরেণু শুকিয়ে যায়, বীজ অকালে শুকিয়ে পক্কতা লাভ করে এবং ফলন কমে যায়। আর অন্যদিকে মাটিতে জলবদ্ধতা থাকলে রোগের আক্রমন হয়। তাই সময়মত সেচ ও নিকাশ ব্যবস্থা করা উচিত।
রোগ ও পোকার আক্রমণঃ রোগ ও পোকার আক্রমণে বীজে সংক্রামক রোগের সৃষ্টি হয়। তাই রোগ ও পোকার আক্রমণ রোধকল্পে বিভিন্ন প্রকার প্রতিরোধ এবং প্রতিকার মূলক ব্যবস্থা অবলম্বন করা উচিত। বীজ শোধন সহ প্রয়োজনমতো বালাইনাশক প্রয়োগ করতে হবে।
রোগিংঃ বীজ ফসলের জমিতে অন্য সবজি, অন্যজাত এবং একই জাতের দূর্বল, লিকলিকে, রোগাক্রান্ত গাছ জন্মালে সেগুলোকে উঠায়ে ফেলাকে রোগিং বলে। এগুলো বেিজর বিশুদ্ধতা বিনষ্ট করে। তাই সময় মত বিশেষ করে পরাগায়নের পূর্বেই এগুলোকে উঠায়ে ফেলতে হবে।
স্বতন্ত্রীকরণঃ বীজের বংশগত বিশুদ্ধতা সংরক্ষণকল্পে পরাগায়ণ রোধ করার জন্য বীজ ফসল একটি নির্ধারিত দূরত্বে চাষাবাদ করা হয়। একই স্বতন্ত্রীকরণের ফলে বিভিন্ন জাতের মধ্যে পরাগায়ণ ঘটে না, ফসল সংগ্রহ কালে বিভিন্ন জাতের মিশ্রণ ঘটেনা এবং স্ব-জাতীয় অন্যান্য ফসল থেকে বীজ ফসলে পোকামাকড় ও রোগ জীবাণুর বিস্তার ঘটে না। সেকারনে বীজের স্বাস্থ্য ও বিশুদ্ধতা রক্ষার্থে বীজ ফসলে স্বতন্ত্রীকরণ অবশ্য প্রয়োজনীয়। দূরত্ব কিংবা সময়ের ব্যবধানে বীজ ফসলে স্বতন্ত্রীকরণ করা যেতে পারে। দূরত্বের ব্যবধানে স্বতন্ত্রীকরণ করার সময় বিবেচনা করতে হবে যে ফসলটি স্ব-পরাগায়িত না পরপরাগায়িত ফসল। যেসব ফসলে প্রধানত পরপরাগায়ণ ঘটে সেগুলোর ক্ষেত্রে স্বতন্ত্রীকরণ দূরত্ব অধিক হওয়া প্রয়োজন। বীজ ফসলের মাঝে বাঁধা প্রদানকারী ফসল, দালান কোঠা অথবা অন্য কোন বাঁধা থাকলে এ দুরত্ব কিছুটা কমানো যায়। ভূট্টা, সূর্যমূখী কিংবা অন্যকোন লম্বা ও ঘন ফসলকে বাঁধা প্রদানকারী ফসল হিসাবে ব্যবহার করা যায়। বীজ ফসলে সময়ের ব্যবধানেও স্বতন্ত্রীকরণ করা যেতে পারে। অর্থাৎ বজি ফসল রোপণের বেশ পূর্বে অথবা পরে সে জমির আশ-পাশে অন্য ফসল এমনভাবে উৎপাদন করা উচিত যাতে করে বীজ ফসলের সাথে পরপরাগায়ণ ঘটার কোন সুযোগ থাকেনা। আবার অল্প পরিমাণ বীজ উৎপাদনের ক্ষেত্রে পরাগায়নের সময় গ্রীন হাউজ বা এ ধরনের কোন ব্যবস্থা করে স্বতন্ত্রীকরণ করা যেতে পারে। সবজি ফসলের বেলায় সাধারনত: ৫০ মিটার থেকে ১০০০ মিটার বা তারও অধিক দুরত্ব পর্যন্ত স্বতন্ত্রীকরণ করা হয়ে থাকে।
ছাটাইকরণঃ বীজ ফসল চাষাবাদ করার ক্ষেত্রে কিছু অবাঞ্ছিত ডালপালা, শাখা-প্রশাখা সময় মত কেটে দিলে গাছ সুদৃঢ ও মজবুত এবং সুস্থ সবল হয়। এই ধরনের গাছ থেকে গুণগত মানসম্পন্ন বীজ পাওয়া যায়। শসা, কুমড়া, লাউ ইত্যাদির ক্ষেত্রে গাছের প্রধান ৩-৪টি শাখা রেখে অন্যান্য শাখা প্রশাখা ছাটাই করলে ফল ও বীজের গুণাবলী উন্নত হয়।
ফল পাতলাকরণঃ সাধারনত গাছের গোড়ার এবং আগার দিকের ফল রোগাক্রান্ত ও ক্ষুদ্রাকৃতির হয়। তাই এগুলোকে সরিয়ে ফেললে গাছের মাঝের ফলগুলি সঠিক আকার-আকৃতি এবং গুনগত মানসম্পন্ন হয়। এতে ফলগুলি পরিপুষ্ট হয় এবং ভাল বীজ পাওয়া যায়।
বীজ ফসল কর্তন এবং সংগ্রহঃ বীজের গুণাগুণ এবং ফলন নিশ্চিত করতে হলে সঠিকভাবে পরিপক্কতার পর ফসল কর্তন করে বীজ সংগ্রহ করতে হবে। অপরিপক্ক অথবা অতি পরিপক্ক ফসল সংগ্রহ করলে বীজের ফলন ও গুণাগুণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অথিকাংশ সবজিতেই সব ফসল বা একই গাছের সব বীজ বা ফল একত্রে পরিপক্কতা লাভ করে না। বিভিন্ন ফসলে বীজের পরিপক্কতার ধরণ ও লক্ষণ বিভিন্ন। তাই সঠিকভাবে পরিপক্কতা লাভের পর বীজ ফসল সংগ্রহ করতে হবে।
বীজ প্রক্রিয়াজাতকরণ এবং সংরক্ষণঃ বীজ প্রক্রিয়াতাকরণ বলতে বুঝায় বীজকে খডকুটা, ধুলাবালি, জড় পদার্থ এবং অন্যান্য বীজের সংমিশ্রণ থেকে মুক্ত করে বীজের মান উন্নয়নের জন্য সংরক্ষন ও ব্যবহার উপযোগী করা। প্রথমে বীজকে মৃদু বাতাসে উড়িয়ে বা কুলার সাহায্যে ঝেড়ে ও হাতে বেছে বীজের মধ্যে অবস্থিত খড়কুটা ও লালবালি, কাকড়, মাটির ঢেলা এবং অন্যান্য বীজের সংমিশ্রণ দূর করা। পরে বীজকে বিভিন্ন আকার-আকৃতির ছিদ্রযুক্ত চালনী ও কুলার সাহায্যে চেলে ও ঝেড়ে সঠিক আকার আকৃতির বীজ বের করা হয়। কারণ বীজে জলীয় অংশ বেশী থাকলে বীজের মান দ্রুত নষ্ট হয়ে যায় এবং বীজ বেশী দিন সংরক্ষণ করা যায় না। বীজ বিভিন্ন প্রকার রোগ জীবাণু দ্বারা আক্রান্ত হয়। বীজে জলীয় অংশ ৬-৮% এ কমিয়ে আনতে হয়।
সবজি বীজ সরাসরি শুকনো মাটির উপরে চাটাই, মাদুর, চট ও পলিথিনের উপরে বা পাকা মেঝেতে ছড়িয়ে রোদ্রে শুকানো যেতে পারে। প্রখর রোদ্রে বীজ শুকানো ঠিক নয়। শুকানোর সময় বীজ মাঝে মাঝে নাড়াচাড়া করলে সমভাবে শুকায়। ভালোভাবে শুকানোর পরে বীজ ঠান্ডা করতে হবে। বীজ শুকালো কিনা তা দাঁত দিয়ে চাপ দিয়ে দেখাতে হবে। যদি কট কট শব্দ হয় তবে বুঝা যাবে যে ভাল ভাবে শুকায়েছে। শুকানো বীজ যে কোন ধরনের টিনের পাত্রে বা ড্রামে রাখলে ভালো থাকবে। এছাড়া মোটা পলিথিন ব্যাগে, রঙ্গিন কাচের বৈয়মে শুকানো বীজ রেথে ভালোভাবে মুখ বন্ধ করে দিতে হবে। বীজ রাখার সময শুকনো নিমপাতা, বিষকাটালী পাতার গুড়া দিলে রোগ ও পোকা দ্বারা আক্রান্ত হয় না। সংরক্ষিত বীজ মাঝে মাঝে রোদ্রে শুকায়ে রাখলে তা পরবর্তী মৌসুম পর্যন্ত ভালো থাকবে।
লেখকঃ প্রাক্তন চেয়ারম্যান, প্লান্ট প্যাথলজি বিভাগ, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়।