Friday, August 22, 2025
spot_img
spot_img
spot_img
spot_img
spot_img
spot_img
spot_img
spot_img
spot_img
spot_img
HomeFeatureমাটির বুকে মাইলফলক: বাকৃবির ৬৫ বছরের গৌরবগাঁথা

মাটির বুকে মাইলফলক: বাকৃবির ৬৫ বছরের গৌরবগাঁথা

Print Friendly, PDF & Email

বাকৃবি প্রতিনিধি: ময়মনসিংহের প্রাচীন ব্রহ্মপুত্রের পশ্চিম তীরে সবুজ-শ্যামল প্রান্তরে দাঁড়িয়ে আছে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (বাকৃবি)। গ্রামীণ প্রাণপ্রকৃতি, কৃষকের ঘাম ও মাটির গন্ধে ভরা এই ক্যাম্পাস যেন কৃষিনির্ভর বাংলাদেশের আলোকদ্বীপ। খাদ্য নিরাপত্তা ও কৃষি উন্নয়নে এর অবদান অপরিসীম। ২০২৫ সালে বিশ্ববিদ্যালয়টি ৬৫ বছরে পদার্পণ করল, যা জাতির গৌরবময় মাইলফলক।

১৯৬১ সালের ১৮ আগস্ট ব্রহ্মপুত্রের কোলঘেঁষে ১২শ একর জমির ওপর বিশ্ববিদ্যালয়টির যাত্রা শুরু হয়। প্রাথমিকভাবে ৬ অনুষদ নিয়ে শুরু হলেও বর্তমানে রয়েছে ৪৬টি বিভাগ ও বিশ্বমানের গবেষণালয়। প্রতিষ্ঠার পর থেকে এখন পর্যন্ত ৫৭ হাজারেরও বেশি শিক্ষার্থী এখান থেকে ডিগ্রি অর্জন করেছেন, এর মধ্যে স্নাতক ৩২ হাজার ৯১৭ জন, স্নাতকোত্তর ২৩ হাজার ৮৪৩ জন এবং পিএইচডি ১ হাজার ৪৯ জন। বর্তমানে প্রায় ৬ হাজার শিক্ষার্থী অধ্যয়নরত, যাদের পথপ্রদর্শক ৫১৪ জন শিক্ষক।

শিক্ষার্থীদের জন্য রয়েছে সমৃদ্ধ গ্রন্থাগার যেখানে ২ লক্ষাধিক বই, ২২ হাজারের বেশি থিসিস, প্রায় ৪৮ হাজার বাধাইকৃত সাময়িকী, ৪১০০ ই-বুকস ও বিভিন্ন অনলাইন জার্নালের সুবিধা রয়েছে। আবাসনের জন্য ১৪টি হলের পাশাপাশি মেয়েদের জন্য আরও ২টি হল নির্মাণাধীন।

শুধু সংখ্যা নয়, গুণমানেই সাফল্যের মাপকাঠি। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (বাকৃবি) শিক্ষা ও গবেষণায় আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্জন করেছে। যুক্তরাজ্যের ‘টাইমস হায়ার এডুকেশন’-এর ২০২৫ সালের এশিয়ার সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় বাকৃবি রয়েছে ৪০১-৫০০ অবস্থানে। ওয়েবমেট্রিক্সের সাম্প্রতিক র‍্যাংকিংয়ে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে প্রথম, দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে নবম এবং বিশ্বে ২৩২৩তম। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে কৃষিবিজ্ঞানের প্রতিটি ধাপে বাকৃবির অবদান অনন্য, খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা, লবণাক্ত ও খরা সহিষ্ণু ফসল, উচ্চফলনশীল জাত, পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি, প্রাণিজ ভ্যাকসিন ও আধুনিক যন্ত্রপাতি উন্নয়নে এ বিশ্ববিদ্যালয় দেশের কৃষির প্রকৃত আলোকবর্তিকা।

গবেষণাগারে জেগে ওঠা অসংখ্য উদ্ভাবনের মধ্যে আছে বাউধান-৬৩, বাউধান-২, বাউধান-৩; বাউকুল ‘সম্পন্ন’ ও ‘সম্বল’; সর্ষের জাত বাউ-এম/৩৯৫, বাউ-এম/৩৯৬, অল্টারনারিয়া ব্লাইট প্রতিরোধী বাউ সর্ষে-৪, ৫, ৬। আছে সয়াবিনের জাত ‘ডেভিস’, ‘ব্র্যাগ’, ‘সোহাগ’ ও ‘বিএস-৪’; আলুর জাত ‘কমলা সুন্দরী’ ও ‘তৃপ্তি’; কচুরমুখি ‘লতিরাজ’, ‘বিলাসী’, ‘দৌলতপুরী’; মিষ্টি আলুর তিনটি উন্নত জাত। আছে সৌর তাপে বীজ রোগ নিয়ন্ত্রণ প্রযুক্তি, শুকনো পদ্ধতিতে বোরো চাষ, অ্যারোবেক প্রযুক্তি, রাইজোবিয়াল জৈব সার, মাটি ও পানিতে ব্যবহারযোগ্য পরিবেশবান্ধব ছত্রাকনাশক ও সয়েল টেস্টিং কিট।

প্রাণিসম্পদ খাতে এসেছে যুগান্তকারী সাফল্য। প্রাণিসেবা সহজ করতে তৈরি হয়েছে মোবাইল অ্যাপ: ‘ডিজিটাল খামারি’। এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জা ও রাণীক্ষেতের ভ্যাকসিন, গবাদিপশুর ম্যাস্টাইটিসের ভ্যাকসিন, ব্রুসেলা ভ্যাকসিন, ফাউল কলেরার ভ্যাকসিন, উন্নত জাতের পশুপাখি, প্রোবায়োটিক খাদ্য, ইন-ভিট্রো ফার্টিলাইজেশন, ক্লোনিং প্রযুক্তি, সবই বাকৃবি গবেষকদের মেধার অবদান।

মৎস্য খাতেও সাফল্যের ব্যাপক সমারোহ রয়েছে। দেশি মাছের কৃত্রিম প্রজনন, হাইব্রিড তেলাপিয়া ও মাগুর, খাঁচায় মাছ চাষ, ধানখেতে মাছ চাষ, মাছের জিনোম সিকোয়েন্স, পোনার ব্ল্যাক সোলজার খাদ্য প্রযুক্তি-সবই কৃষকের হাতে তুলে দিয়েছে নতুন সম্ভাবনা।

১৯৮৪ সালে প্রতিষ্ঠিত ‘বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় রিসার্চ সিস্টেম’ এবং ১৯৮৯ সালে গড়ে ওঠা ‘সম্প্রসারণ কেন্দ্র’ মাঠপর্যায়ে নিয়ে গেছে ল্যাবের উদ্ভাবনগুলো। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের আবিষ্কৃত বীজ, সার, মাছ চাষ পদ্ধতি কিংবা প্রাণিসম্পদ উন্নয়ন প্রকল্প সবই কৃষকের ঘরে পৌঁছে গেছে।

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে (বাকৃবি) গবেষণা ও জ্ঞানচর্চায় সমন্বিত পরিবেশ গড়ে উঠেছে। ক্যাম্পাসে রয়েছে বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট, গ্র্যাজুয়েট ট্রেনিং ইনস্টিটিউট, ফুড সিকিউরিটি ইনস্টিটিউট ও হাওর-চর উন্নয়ন ইনস্টিটিউটসহ একাধিক প্রতিষ্ঠান। এছাড়া দেশের প্রথম কৃষি জাদুঘর, উপমহাদেশের প্রথম মৎস্য জাদুঘর, প্রায় সাড়ে চার হাজার বৃক্ষের বোটানিক্যাল গার্ডেন ও ১১ হাজারেরও বেশি উদ্ভিদের জার্মপ্লাজম সেন্টার মিলে ক্যাম্পাসকে করেছে জীবন্ত কৃষি-অভিজ্ঞতার ভাণ্ডার।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ৬৫ বছর পূর্তিতে ১৮ আগস্ট সকালে জাতীয় ও বিশ্ববিদ্যালয়ের পতাকা উত্তোলন, কবুতর অবমুক্তকরণ ও আনন্দ র‌্যালির মধ্য দিয়ে দিনটি শুরু হয়। উপাচার্য অধ্যাপক ড. এ কে ফজলুল হক ভূঁইয়ার নেতৃত্বে বৃক্ষরোপণ, মাছের পোনা অবমুক্তকরণ ও আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। মসজিদ-মন্দিরে দেশের অগ্রগতির জন্য বিশেষ প্রার্থনা করা হয়।

বাকৃবির ৬৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে শিক্ষার্থীরা তাদের অনুভূতি ব্যক্ত করেছেন। 

কৃষি অনুষদের তানজিলা হক বলেন, “বাকৃবি শুধু বিশ্ববিদ্যালয় নয়, এটা আমার দ্বিতীয় বাড়ি। প্রতিটি গাছ, লেক ও গবেষণাগারে আমি নিজের স্বপ্নকে বেড়ে উঠতে দেখি। যখন আমাদের উদ্ভাবিত ধান বা সবজির জাত কৃষকের মাঠে ফলছে, বুক ভরে যায় গর্বে।”

ভেটেরিনারি অনুষদের মেহেদী হাসান বলেন, “ছোটবেলা গ্রামে গরু-ছাগল অসুস্থ হলে সাহায্য পাননি। আজ সেই স্বপ্ন নিয়েই বাকৃবিতে পড়ছি। মনে হয় আমি শুধু ডাক্তার নই, কৃষকের ভরসা হয়ে উঠছি।”

মাৎস্যবিজ্ঞান অনুষদের নুসরাত জাহান বলেন, “মাছ ধরা আমাদের গ্রামে জীবনযুদ্ধ। এখানে এসে দেখলাম মাছ শুধু খাদ্য নয়, দেশি মাছের প্রজনন ও খাঁচায় চাষ প্রযুক্তি সারা দেশে ছড়িয়ে যাচ্ছে।”

কৃষি প্রকৌশল ও প্রযুক্তি অনুষদের শিহাব উদ্দিন বলেন, “প্রথম দিন মনে হয়েছিল আমি স্বপ্নের ভেতর। সবুজ ক্যাম্পাস, গবেষণাগার ও শিক্ষকদের স্নেহ আমাকে মনে করিয়ে দেয়, আমি এমন এক পরিবারের অংশ, যারা কৃষি ও কৃষকের ভবিষ্যৎ গড়ে তুলছে।”

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) উপাচার্য অধ্যাপক ড. এ কে ফজলুল হক ভূঁইয়া বলেছেন, “বাকৃবি বিশ্বমানের পাঠ্যসূচি, আধুনিক ল্যাবরেটরি এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের আন্তর্জাতিক মানের শিক্ষা দিচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দেওয়া ডিগ্রিসমূহ সময়োপযোগী ও বিশ্বব্যাপী চাহিদাসম্পন্ন। উত্তীর্ণ গ্র্যাজুয়েটরা সরাসরি দেশের সেবায় নিয়োজিত হওয়ার সুযোগ পাচ্ছে। অনেক কৃষিবিজ্ঞানী জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে পুরস্কৃত হয়েছেন এবং পেশাগতভাবে বিকশিত হয়ে দেশের কৃষি-সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করেছেন। ফলে দেশ ক্রমবর্ধিষ্ণু জনসংখ্যার জন্য খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তায় অসামান্য সাফল্য অর্জন করেছে।”

এই বিশ্ববিদ্যালয় কেবল শিক্ষাঙ্গন নয়, এটি প্রকৃতির কন্যা- যে মাটির বুকে জন্ম নিয়ে কৃষকের ঘামকে রূপান্তর করেছে সোনালি ধানে, মাছের ঝাঁকে, প্রাণীর স্বাস্থ্যোন্নয়নে, আর প্রযুক্তির নতুন দিগন্তে। ৬৫ বছরের স্বপ্নযাত্রা একদিকে ইতিহাস, অন্যদিকে ভবিষ্যতের দিশা।

আজ যখন জলবায়ু পরিবর্তনের হুমকি, কৃষিজমির ক্রমহ্রাস, খাদ্য নিরাপত্তার চাপ আমাদের সামনে, তখন বাকৃবি এক নির্ভরতার নাম। আগামী দিনেও এই প্রকৃতি কন্যা তার সবুজ হাতছানি দিয়ে কৃষিকে, কৃষককে, আর বাংলার মানুষকে বাঁচিয়ে রাখবে উন্নয়নের অগ্রযাত্রায়।

RELATED ARTICLES
- Advertisment -spot_img

Most Popular

Recent Comments