হাবিপ্রবি প্রতিনিধি: ২০১৪ সাল থেকে হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে কার্যক্রম শুরু হয় স্থাপত্য বিভাগের। বর্তমানে ইন্জিনিয়ারিং অনুষদের অন্তর্ভুক্ত থাকা এ বিভাগটি প্রতিষ্ঠার দশ বছর অতিক্রম করলেও বিভাগটিতে কাটেনি ক্লাসরুম এবং শিক্ষক সংকট। দশ বছরে শিক্ষা কার্যক্রম সম্পন্ন করতে পেরেছে মাত্র তিনটি ব্যাচের শিক্ষার্থীরা। বর্তমানে চলমান সাতটি ব্যাচের জন্যও নেই পর্যাপ্ত ক্লাসরুম এবং স্টুডিও সুবিধা। ফলে অনেকটা ধুঁকে ধুঁকে চলছে এই বিভাগটির শিক্ষা কার্যক্রম।
এই বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য বিভাগের স্নাতক ডিগ্রী পাঁচ বছর মেয়াদী হলেও সেশনজটের কারণে তা সম্পন্ন করতে সময় লাগছে ৭.৫-৮ বছর। জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়টির অন্যান্য বিভাগের ১৮ ব্যাচের শিক্ষার্থীরা অনেক আগেই তাদের স্নাতক ডিগ্রী শেষ করে বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়লেও স্থাপত্য বিভাগের ১৮ ব্যাচের শিক্ষার্থীরা এখনও পঞ্চম বর্ষের প্রথম সেমিস্টারে অধ্যয়নরত। একই অবস্থা বিভাগটির ২২ ব্যাচের ক্ষেত্রেও। যেখানে অন্যান্য বিভাগের একই ব্যাচের শিক্ষার্থীরা দ্বিতীয় বর্ষ শেষ করার অপেক্ষায় সেখানে স্থাপত্য বিভাগের ২২ ব্যাচের শিক্ষার্থীদের এখনও প্রথম বর্ষই শেষ হয়নি। এছাড়াও যে তিনটি ব্যাচের শিক্ষার্থীরা বের হয়ে গেছে তাদের মধ্যে ১৪ ব্যাচ এর সময় লেগেছে সাড়ে সাত বছর এবং ১৫ ও ১৬ ব্যাচের সময় লেগেছে যাথাক্রমে আট বছর করে। এই বিভাগের চলমান সাতটি ব্যাচে শিক্ষার্থী রয়েছে প্রায় ৩৫০ জন এবং শিক্ষক রয়েছেন ৮ জন। বর্তমান শিক্ষকদের মধ্যে ৩ জন শিক্ষাছুটিতে থাকায় ৫ জন শিক্ষক দিয়েই চলছে এই বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার কার্যক্রম। বিশ্বব্যাপী উচ্চতর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর গড় অনুপাতের ন্যূনতম মানদণ্ড ধরা হয় ১:২০। অর্থাৎ ২০ জন শিক্ষার্থীর বিপরীতে কমপক্ষে একজন শিক্ষক থাকতে হবে। কিন্তু বিভাগটিতে ৩৫০ জন শিক্ষার্থীর বিপরীতে বর্তমানে ৫ জন শিক্ষক হিসাব করলে যার অনুপাত হয় ১:৭০। শিক্ষক সংকট কাটাতে সর্বশেষ দুটি নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে ৪ জন শিক্ষক নিয়োগ হলেও যোগদান করেছেন মাত্র ১ জন শিক্ষক। শিক্ষক নিয়োগ হলেও প্রশাসনের ধীরগতির কারণে তাদের নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হতে সময় লাগে ৬ মাস থেকে ১ বছর। ফলে নিয়োগ পাওয়া শিক্ষকরাও অন্য প্রতিষ্ঠানে যোগদান করায় ফাঁকা পরে থাকে এসব পদ। যার কারণে আর দূর করা সম্ভব হয়নি শিক্ষক সংকট।
শিক্ষক সংকটের পাশাপাশি এ বিভাগটিতে ক্লাসরুম এবং স্টুডিও সংকটও প্রবল। অন্যান্য ডিগ্রি থেকে এ বিভাগটির ল্যাব, ক্লাসরুম, চেয়ার-টেবিলও প্রয়োজন হয় আলাদা ধরনের। ফলে নিজস্ব ক্লাসরুম ছাড়া অন্য কোথাও এ বিভাগের পাঠদান সম্ভব নয়। এরপরও প্রতিষ্ঠার দশবছর পার হলেও এখনও পর্যন্ত অনেক আসবাবপত্র এবং যন্ত্রপাতি আনা হয়নি শিক্ষার্থীদের ল্যাব এবং ক্লাসরুমের জন্য। তৈরি করা হয়নি আলাদা কোন স্টুডিও। এমনকি নিয়োগ দেয়া হয়নি কোন ল্যাব টেকনিশিয়ানও। নবনির্মিত কুদরত-ই-খুদা একাডেমিক ভবন নির্মাণের পূর্বে তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক ড. আবুল কাশেম স্থাপত্য বিভাগের জন্য জায়গা বরাদ্দ দেয়ার আশ্বাস দিলেও তা যথাযথভাবে অনুসরণ করা হয়নি। সেই ভবনে ইন্জিনিয়ারিং ফ্যাকাল্টির অন্য বিভাগগুলো স্থানান্তর করে পূর্বের ইন্জিনিয়ারিং বিল্ডিং (একাডেমিক ভবন-২) পুরোটা স্থাপত্য বিভাগের জন্য বরাদ্দ করলেও সেখানে ল্যাব স্থাপনের জন্য কোন বরাদ্দ এখন পর্যন্ত না দেয়ায় পরিপূর্ণভাবে শিক্ষা কার্যক্রম এখনও শুরু হয়নি। উল্টো এই বিল্ডিং পুরোটা বরাদ্দ পাওয়ায় ‘ওয়াজেদ মিয়া একাডেমিক বিল্ডিং’ এ স্থাপত্য বিভাগের জন্য বরাদ্দকৃত দুইটি রুম ফেরত নেয়ায় শিক্ষার্থীরা আরও বিপাকে পরেছেন বলে অভিযোগ আছে তাদের।
সেশনজটের বিষয়ে শিক্ষার্থীদের কাছে জানতে চাওয়া হলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন বলেন,
“দশ বছরে আমাদের মাত্র তিনটা ব্যাচ বের হয়েছে ১৪, ১৫ ও ১৬ ব্যাচ। আপনারা জানেন আমাদের ডিগ্রি ৫ বছরের সেখানে ৬ বছর লাগলেও মানা যায় কিন্তু লাগছে ৮ বছর। ১৮ ব্যাচের আমাদের ব্যাচমেটগুলো সবাই বের হয়ে চলে গেছে আর আমাদের এখনো লেভেল-৫ সেমিস্টার-১ চলছে। আমার বাবা একজন কলেজের পিয়ন, আমি ১৮ সালে ভর্তি হয়েছি। নিজে টিউশনি করে, কষ্ট করে কোনমতে নিজের পড়ালেখার খরচ এতোদিন চালাচ্ছি। আমাদের ডিগ্রিটি এমনিতেও অনেক ব্যয় বহুল। মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্তদের জন্য আট বছর পড়াশোনার খরচ চালানো প্রায় অসম্ভব। দীর্ঘ সেশনজটের ভয়াবহতায় মানসিক চাপ নিতে না পেরে ইতোমধ্যেই বেশ কয়েকজন হাল ছেড়েও দিয়েছে।”
এ বিষয়ে স্থাপত্য বিভাগের চেয়ারম্যান স. ম. নাঈম হোসেন মিথুন বলেন, “স্থাপত্য বিভাগের ডিগ্রি পাঁচ বছরের এবং ১৯৬ ক্রেডিট। আমাদের বিভাগে ৮ জন শিক্ষক থাকলেও বর্তমানে ৩ জন শিক্ষা ছুটিতে রয়েছে। আমাদের বর্তমানে ৭টি ব্যাচ চলমান। ক্লাস ও ডিজাইন স্টুডিও সঠিকভাবে পরিচালনার জন্য প্রায় ৩৮ জন শিক্ষক প্রয়োজন। একটা ব্যাচের ডিজিটাল স্টুডিওর জন্য দুজন শিক্ষক প্রয়োজন। কিন্তু আমাদের রয়েছে মাত্র ৫ জন শিক্ষক। তাছাড়া আমাদের ক্লাসরুম ও ডিজাইন স্টুডিও টিএসসি, ওয়াজেদ ভবন এবং একাডেমিক ভবন ২-এ বিচ্ছিন্নভাবে রয়েছে। এ জন্য শিক্ষকরা চাইলেও দুইটা ব্যাচের ডিজাইন স্টুডিও সমান্তরালভাবে পরিচালনা করা সম্ভব হয় না। যদি আমরা একটা ভবনে থাকতে পারতাম তবে সেশনজট অর্ধেকে নামিয়ে আনা সম্ভব হবে। আমরা প্রশাসনের কাছে বারবার একাডেমিক ভবন-২ সংস্কাররের জন্য বলেছি। বিগত প্রশাসনের সময় আমরা শুধু ডিজাইন স্টুডিও করার জন্য দুইটা রুমের ভেতরের দেয়াল ভেঙে রুমগুলো বড় করার আবেদন করা হয়। তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক ড. এম কামরুজ্জামান অনুমোদন দিলেও প্রশাসনিক জটিলতায় সেটিও থমকে আছে। এ ছাড়া শিক্ষক নিয়োগে প্রশাসনের ধীর গতি তো রয়েছেই।” এ সময় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের প্রতি তিনি দ্রুত একাডেমিক ভবন-২ সংস্কার করার আহ্বান জানান।
সেশনজট সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলে ইন্জিনিয়ারিং অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. মফিজউল ইসলাম বলেন, “স্থাপত্য বিভাগের সেশনজটের পেছনে শিক্ষক সংকট মূখ্য কারণ। প্রশাসনের শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে ধীর গতির কারণে বিগত দুইটা বিজ্ঞপ্তিতে শিক্ষক যোগদান করেননি। তবে আমরা গেষ্ট টিচার এর মাধ্যমে তত্ত্বীয় বিষয়গুলো দ্রুত শেষ করার চেষ্টা করছি। ক্লাসরুম ও ডিজাইন স্টুডিও সংকট দ্রুত সময়ে কেটে যাবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক ভবন ২ এর কিছু সংস্কার কাজ হয়ে গেলে এই সংকট কেটে যাবে।”