ফসল উৎপাদনের প্রধান উপকরণ হলো মানসম্পন্ন বীজ। দেশে সরকারি-বেসরকারি সংস্থা মিলে শতকরা ৩০ ভাগ মানসস্পন্ন বীজ সরবরাহ করছে। বাকি বীজ কৃষকের। নিজে রাখে এবং বিভিন্ন প্রাইভেট কোম্পানি বিদেশ থেকে আমদানি করে দেশের চাহিদা পূরণ করে। সাধারণত আমাদের দেশের চাষিরা ।নিজ নিজ ফসলের অপেক্ষাকৃত ভালো অংশ পরবর্তী ফসলের বীজ হিসাবে ব্যবহার করে। কিন্তু একই বীজ থেকে বার বার চাষ করলে ফসলের ফলন অনেক হ্রাস পায়। তাই প্রায় ২-৩ বছর পর পর বীজ পরিবর্তন খুবই জরুরি। মানসম্পন্ন প্রত্যায়িত ভালো বীজ ব্যবহারের মাধ্যমে ১৫-২০ শতাংশ পর্যন্ত বর্ধিত ফলন পাওয়া সম্ভব। বীজ উৎপাদনের জন্য বপন/রোপণ দূরত্ব, সার, সেচ ও বালাই ব্যবস্থাপনা সম্পূর্ণ ভিন্ন হয়ে থাকে। এজন্য বীজ উৎপাদন ও সংরক্ষণ প্রযুক্তি ফসল উৎপাদন ও সংরক্ষণ প্রযুক্তি থেকে ভিন্নতর। তাছাড়া এক মৌসুমে উৎপাদিত বীজ পরবর্তী মৌসুমে বা পরবর্তী বৎসরে ব্যবহার করতে হয় বিধায় অনেকসময় বীজ একটা দীর্ঘ সময় সংরক্ষণ করতে হয়। তাই মানসম্পন্ন বীজ উৎপাদন ও সংরক্ষণে বীজ প্রযুক্তি বিষয়ে জ্ঞান থাকা আবশ্যক। মানসম্পন্ন বীজের জন্য বীজের জেনেটিক বিশুদ্ধতা অপরিহার্য । বীজ বিশুদ্ধ হতে হবে এবং গজানোর ক্ষমতা ৮০% এর বেশি থাকতে হবে। অঙ্কুরোদগম পরীক্ষা, ত্বরিত বার্ধক্য পরীক্ষা, টেট্রাজোলিয়াম পরীক্ষা এবং উষ্ণ অঙ্কুরোদগম পরীক্ষা। প্রতিটি পরীক্ষা বীজের বিভিন্ন গুণাবলী মূল্যায়ন করার হয়। সাধারণ পরীক্ষা হল একটি উষ্ণ অঙ্কুরোদগম পরীক্ষা কারণ এটি বীজ আইন দ্বারা প্রয়োজনীয়। উৎপাদন এবং উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি, সময়মতো বীজের প্রাপ্যতা কৃষক সম্প্রদায়ের কাছে যুক্তিসঙ্গত মূল্যে মানসম্পন্ন বীজ প্রয়োজন। মানসম্পন্ন বীজের দক্ষ ব্যবহারের ক্ষমতা রয়েছে সার এবং সেচের মতো উপকরণ, যাতে খাদ্য নিরাপত্তা ও পুষ্টি নিশ্চিত করা যায়। কৌলিতাত্ত্বিকভাবে বিশুদ্ধতা রয়েছে সেই বীজই হলো বিশুদ্ধ মানসম্পন্ন বীজ। বীজের অংকুরোদগম ক্ষমতা, আর্দ্রতা, কৌলিক বিশুদ্ধতা ও ভাইয়াবিলিটি এসব যদি পুরোপুরি থাকে, তবে তাকে মানসম্পন্ন বীজ বলা হয়।
বীজ বিধিমালা ভিত্তিক শ্রেণি বিভাগ:
ভিত্তি বীজ: প্রজননবিদের বীজের পরবর্তী স্তর ভিত্তি বীজ যা বীজ প্রযুক্তিবিদদের সরাসরি তত্ত্বাবধানে উৎপাদন করা হয়। প্রত্যয়িত বীজ: ভিত্তি বীজ থেকে প্রত্যয়িত বীজ উৎপাদন করা হয়। বিএডিসির নিজস্ব খামার সমূহে এবং কন্ট্রাক্ট গ্রোয়ার্স জোন সমূহে প্রত্যয়িত বীজ উৎপাদিত হয়। মান ঘোষিত বীজ: ভিত্তি বীজ বা প্রত্যয়িত বীজ থেকে মান ঘোষিত বীজ উৎপাদন করা হয়।
উন্নত মানের বীজের বৈশিষ্ট্য:
‘ভালো বীজ ভালো ফসল’। ভালো বীজ মানে উন্নতমানের বীজ। মান সম্পন্ন বীজ বিভিন্ন শ্রেণির হতে পারে যেমন- মৌল বীজ, ভিত্তি বীজ, হাইব্রিড বীজ ইত্যাদি। মান সম্পন্ন বীজের বৈশিষ্ট্য সমূহ নিম্নরূপ: বিশুদ্ধ বীজ (কম পক্ষে ৯৮%বিশুদ্ধতা) । উজ্জ্বল, সুন্দর, সতেজ, স্বাভাবিক রঙ এর বীজ। পুষ্ট, বড় দানা সম্পন্ন বীজ। পোকা ও রোগ মুক্ত বীজ। বীজের আর্দ্রতা সর্বোচ্চ ১২% (ধান, গম) অন্যান্য ফসল ১০%। গজানোর ক্ষমতা ৭০-৮৫% এর উপরে। বাহ্যিক চেহারা হবে উজ্জ্বল, সুন্দর, আকার, আয়তন ও জৌলুস ক্রেতার দৃষ্টি আকর্ষণ করবে। বীজে কোন নিষ্ক্রিয় পদার্থ বালি, পাথর, ছোট মাটি, ভাঙ্গা বীজ, বীজের খোসা ইত্যাদি থাকবে না। বীজে হতে হবে বিশুদ্ধ। বীজে ক্ষতিকর আগাছার বীজ থাকবে না। বীজ হতে হবে পুষ্ট। আকার, আয়তন, দৈর্ঘ্য, প্রস্থ, ওজন, জাত অনুযায়ী নির্দিষ্ট থাকতে হবে। বীজের আর্দ্রতা নির্ধারিত মাত্রায় থাকতে হবে। (ধান, গম, ভুট্টার বেলায় ১২%, ডালজাতীয় শস্যের বেলায় ৯%, পাট ৯%, সরিষা ৮%। বীজ ক্ষতিকারক পোকামাকড়ের আক্রমণ মুক্ত ও নীরোগ হতে হবে। প্রয়োজনে বীজের সুপ্তাবস্থা কাটানোর ব্যবস্থা করতে হবে। অবশ্য কৃষকদের নিকট অবশ্যই সুপ্তাবস্থা কাটানো বীজ যা সঙ্গে সঙ্গে ব্যবহার করা যায় তা সরবরাহ করতে হবে। সর্বোপরি বীজের অংকুরোদগম ক্ষমতা নির্ধারিত মানের হতে হবে। (সর্বনিম্ন ধান ৮০%, গম ৮৫%, ডালশস্যা ৭৫-৮৫%, শাক-সজবি ৭০-৭৫%। বীজ সংরক্ষণে আপেক্ষিক আর্দ্রতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ আপেক্ষিক আর্দ্রতার বৃদ্ধিতে রোগ পোকার আক্রমণ বৃদ্ধি পেতে পারে। বীজ নির্দিষ্ট সময় কাল অবধি সংরক্ষণ করা যায়। শুষ্ক পরিবেশে দীর্ঘদিন সংরক্ষণ করা যায। বীজ যে জাতের সে জাতের নির্দিষ্ট গুণাবলি অবশ্যই থাকতে হবে। জাতীয় বীজ র্বোডের অনুমোদিত বীজ মান অনুসারে একটি ভালো বীজের বিশুদ্ধতা হতে হবে ৯৬% হতে ৯৯% ভাগ। মিশ্রণ মুক্ততা: ভালো বীজ অবশ্যই সব ধরনের মিশ্রণ মুক্ত হতে হবে অর্থাৎ একটি ভালো বীজে জড় পদার্থ, আগাছার বীজ বা অন্য ফসলের এমনকি অন্য জাতের মিশ্রণ থাকা চলবে না। জাতীয় বীজ মান অনুসারে একটি ভালো বীজে সর্বোচ্চ ০১ ৩% পর্যন্ত জড় পদার্থ, অন্য ফসলের বীজ বা আগাছার বীজ থাকতে পারে। রোগ ও কীটপতঙ্গ মুক্ততা: বিশুদ্ধ ভালো বীজ অবশ্যই রোগ জীবাণুমুক্ত এবং পোকামাকড়ের আক্রমণ মুক্ত হতে হবে। অংকুরোদগম ক্ষমতা: ভালোবীজ মানেই উচ্চ অংকুরোদগম ক্ষমতা সম্পন্ন বীজ অর্থাৎ অংকুরোদগম ক্ষমতা হতে হবে ৮৫% বা তার ওপরে। জাতীয় বীজ মান অনুসারে ভালো বীজের অংকুরোদগম ক্ষমতা কোনো ক্রমেই ৮০% এর নিচে নয়। বীজের আকার–আকৃতি: নির্দিষ্ট ফসলের নির্দিষ্ট জাতের সব বীজ প্রায় একই আকারের, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন, পরিপক্ব ও পুষ্ট হতে হবে। এছাড়া বীজের জীবনীশক্তি এবং বীজের স্বাভাবিক উজ্জ্বল রঙ থাকতে হবে। ভালো বীজ উৎপাদন ও বাজারজাতকরণ করতে হলে প্রত্যয়ন ট্যাগে লেখা থাকতে হবে ফসলের নাম, জাতের নাম, বীজের শ্রেণী, বীজ ডিলার/উৎপাদকের নাম ও ঠিকানা, লট নম্বর, বীজ পরীক্ষার তারিখ, ট্যাগ ইস্যুর তারিখ, বৈধতার মেয়াদ ও যে পরিমাণ বীজের জন্য প্রত্যয়ন ট্যাগ প্রদানকৃত তার পরিমাণ। প্রত্যায়িত বীজের মাঝে যেহেতু একটি ভালো বীজের সব প্রকার ভালো গুনাগুণ ও বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান, তাই এ বীজ ব্যবহারে ফসলের ফলন অনেক বৃদ্ধি পেয়ে থাকে। সুতরাং অধিক ফসল উৎপাদনে প্রত্যায়িত মানের বীজের গুরুত্ব অপরিসীম।
বীজের মান হ্রাস: ভালো ও বিশ্বস্ত বীজ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ও সংস্থা থেকে মান সম্পন্ন ভালো বীজ ক্রয় করে চাষাবাদ করলে ভালো ফলন পাওয়া যায়। কিন্তু ওই বীজ দিয়ে ধারাবাহিকভাবে কয়েক বছর চাষের ফলে নির্দিষ্ট সময় অবধি ভালো ফলন দেয়ার পর আর আশানুরূপ ভালো ফলন পাওয়া যায় না, বরং ধীরে ধীরে ফলন কমে যায়। আমাদের দেশের পরিবেশে একই বীজ দুই/তিন বছর ভালো ফলন দেয়। এরপর নির্দিষ্ট অঞ্চলের মাটি, জলবায়ু, সুর্যালোকের স্থায়িত্ব, তাপমাত্রা, পরিচর্যা ও পোকামাকড় প্রতিকূল আবহাওয়া ফসলের ফলন ও গুণগত মানে বিরূপ প্রভাব ফেলে।
ভালো বীজ উৎপাদনে রোগিং গুরুত্বপূর্ণ
ভালো বীজ উৎপাদনে রগিং এর গুরুত্ব অনেক। কেননা আপনারা যারা ফসলি আবাদ করেন না তারাও এটা জানবেন, একটি আবাদের মধ্যে যদি অন্য বিভিন্ন প্রকারের আবাদ বা জঙ্গল হয়ে থাকে তাহলে সেটা মূল আবাদের বিভিন্ন প্রকারের সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। রোগিং কয়টি ধাপে সম্পন্ন করতে হয় তাদের কাছে মূলত এই প্রশ্নের উত্তরটি সুস্পষ্ট। তবুও বোঝার সুবিধার্থে আবারো বলছি রোগিং ফুল আসার আগে, ফুল আসার সময় এবং পরিপক্ক পর্যায়ে করা হয়ে থাকে। তবে কিছু কিছু ফসলের শুধুমাত্র ফুল আসার আগে রগিং করলেই সেটা যথেষ্ট। বীজ ফসলে পৃথকীকরণ দূরত্ব বাজায় রাখার প্রধান উদ্দেশ্য (রোগবালাই প্রতিরোধের জন্য, অধিক বীজ উৎপাদনের জন্য, জাতের বিশুদ্ধতা রক্ষার জন্য, ফসলের সহজ পরিচর্যার জন্য) । বাংলাদেশের শতকরা ৮০ ভাগ কৃষক নিজেদের উৎপাদিত বীজের উপর নির্ভরশীল এবং উন্নতমানের বীজের মাধ্যমে কৃষক উৎপাদিত বীজ প্রতিস্থাপনের হার মাত্র শতকরা ২০ ভাগ। উপরন্তু নানা প্রাকৃতিক দূর্যোগে ফলন ক্ষতিগ্রস্থ হলে, বীজ ধানের সরবরাহ সংকটের মুখে পড়ে। কৃষক যাতে তাদের জমিতে উন্নতমানের বীজ উৎপাদন, বাছাই ও বর্ধনের উন্নতি পদ্ধতি এবং বীজ সংরক্ষণে উন্নত কলাকৌশল সম্পর্কে সচেতন হয়ে মানসম্পন্ন বীজ ব্যাপক ব্যবহারের মাধ্যমে ধানের ফলন বৃদ্ধিতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করতে পারেন তার বলিষ্ঠ প্রচেষ্টা নেয়া প্রয়োজন।
বীজ উৎপাদনের আধুনিক পদ্ধতি:
যথাসময়ে বীজ বপন ও চারা রোপণ যেমন জরুরি তেমনি সার, সেচ, কীটনাশক ইত্যাদি প্রয়োগের উপযুক্ত সময় এবং প্রয়োগবিধির প্রতি লক্ষ্য রাখাও গুরুত্বপূর্ণ। বীজ ধানের ভালো ফলন পেতে হলে জাত নির্বাচন থেকে শুরু করে কাটা পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে ফসলের পরিচর্যা করে যেতে হবে।
ভবিষ্যৎ করণীয়:
বীজের কৌলিতাত্ত্বিক বিশুদ্ধতা, ভৌত ও শারীরতাত্ত্বিক বিশুদ্ধতা এবং বীজের স্বাস্থ্য নিয়ে মৌলিক গবেষণা করা প্রয়োজন। উৎপাদনের প্রথম শর্তই হলো বীজের কৌলিতাত্ত্বিক বিশুদ্ধতা বজায় রাখা। এজন্য জীব প্রযুক্তি বিষয়ক প্রযুক্তির সাহায্যে বীজের কৌলিতাত্ত্বিক বিশুদ্ধতা সংক্রান্ত গবেষণা প্রয়োজন। খাদ্যে স্বয়ম্ভরতা অর্জনের জন্য ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধিই একমাত্র পথ। আর এ ফসল উৎপাদন বৃদ্ধির মূল উপকরণই হচ্ছে সুস্থ, সবল, এবং সুপুষ্ট উন্নতমানের বীজ।
মো. ইব্রাহীম আলী, বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, কৃষিতত্ত্ব বিভাগ, বিনা ।