প্রফেসর আবু নোমান ফারুক আহম্মেদঃ আইল ফসল চাষ নতুন বিষয় হলেও চাষবাদপদ্বতি নতুন কিছু নয় । যুগ যুগ ধরে জমিতে ও বসতভিটায় যে পদ্বতিতে ফসল চাষ করা হয়, জমির আইলেও ঠিক সেই একই পদ্বতিতে ফসল চাষ করা যায় । তবে এক্ষেত্রে আইলের ধরনের উপর ভিত্তি করে ফসল নির্বাচন করতে হবে নতুবা আইলকে সেই ফসল চাষাবাদের উপযোগী করে তৌরি করতে হবে । খাদ্য নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে বাংলাদেশের কৃষকরা তাদের সীমিত জমিতে তিন মৌসুমেই ধান চাষ করে থাকে । আর তাই শাকসবজী চাষ থাকে উপেক্ষিত । একারনে কৃষক পরিবারে পুষ্টিহীনতা একটি নৈমত্তিক ঘটনা । কিন্তু ধানী জমির আইলে শাকসবজী চাষ করে একই সাথে পুষ্টির চাহিদা পূরণ ও বাড়তি আয় সম্ভব ।
ধান ক্ষেতের আইলে শাকসবজী চাষের জন্য জমি থেকে মাটি এনে আইল উঁচু করতে হয় । তবে অনেক সময় ধান ক্ষেতে মাছ চাষের জন্য আইল উঁচু করা থাকে । জমির ভিজা মাটি দিয়ে আইল উঁচু করা ঠিক নয় । শুকনো অবস্থায় জমি চাষ দেবার সময় জমি উঁচু করে নিতে হবে । আইলে কখনো ফসল চাষ না করায় এবং আইলের উপর দিয়ে চলাচলের কারনে আইলের মাটি শক্ত হয়ে যায় । এক্ষেত্রে আইলের মাটি কোদাল দিয়ে কুপিয়ে ঢেলামুক্ত, নরম ও ঝুরঝুরে করে নিতে হবে । এছাড়াও আইলে সবসময় আগাছা জন্মে থাকে । তাই পুরাতন আইল কোদাল দিয়ে কোপানোর সময় ভালভাবে আগাছা পরিষ্কার করে সমতল করে নিতে হবে । উত্তমরূপে আইল প্রস্তুত করলে বীজ সহজেই অংকুরিত হতে পারে এবং রোপনকৃত চারার শিকড়ও সহজে বিস্তার লাভ করতে পারে । সরু আইলে সাধারনত একসারি পদ্ধতিতে ফসল চাষাবাদ করা হয় । তবে চওড়া আইলে একই সময়ে বিভিন্ন ধরনের ফসল চাষ করা যায় । মিশ্রফসল চাষে ফসলের প্রকৃতির উপর ভিত্তি করে ফসল নির্বাচন করতে হবে । এক্ষেত্রে গভীরমূলী ফসলের সাথে অগভীরমূলী ফসল, শিমজাতীয় ফসলের সাথে অশিমজাতীয় ফসল, লম্বা জাতীর ফসলের সাথে খাটো জাতীয় ফসল, ছড়ানো প্রকৃতির ফসলের সাথে কম ছড়ানো প্রকৃতির ফসল এবং ছায়া প্রদানকারী ফসলের সাথে ছায়া প্রদানকারী ফসল নির্বাচন করতে হবে । আইল ফসল চাষাবাদের জন্য আইলেন বহিরাকৃতির প্রয়োজনীয় পরিবর্তন করা দরকার । নিম্নরূপে একাজ করা যায় :
১। সরু ও নীচু আইলে পাতা ও ফলজাতীয় সবজি চাষ করার জন্য আইল কমপক্ষে ৪৫ সেমি প্রশস্ত করতে হবে এবং প্রয়োজনীয় পরিমাণ মাটি দিয়ে আইল উঁচু করতে হবে। এক্ষেত্রে সম্পূর্ণ আইল কোদাল দিয়ে কুপিয়ে আগাছা পরিস্কার করে মাটি ঢেলাবিহীন, নরম ও ঝুরঝুরে করে নিতে হবে।
২। জমির কোণায় যদি মাছ চাষের জন্য গর্ত থাকে তবে সেক্ষেত্রে লতাজাতীয় সবজি চাষের জন্য গর্তের কোণায় কিছু মাটি দিয়ে হীপ তৈরি করতে হবে।
৩। সরু ও নীচু আইলে লতানো সবজি চাষ করার জন্য অল্প পরিমান মাটি দিয়ে জমির চার কোণায় চারটি হীপ তৈরি করতে হবে।
৪। নীচু আইলে লতানো সবজি চাষ করার জন্য ধানক্ষেত থেকে মাটি এনে নির্দিষ্ট দূরত্বে মাদা বা হীপ তৈরি করতে হবে।
৫। যে আইলের উপর দিয়ে মানুষ চলাচল করে তাতেই ফসল চাষ করতে চাইলে জমি থেকে মাটি এনে আইলের সাথে জমির দিকে হীপ তৈরি করতে হবে।
৬। এছাড়া ধানক্ষেতের ভিতরেও হীপ তৈরি করে লতাজাতীয় সবজি চাষ করা যায় । এক্ষেত্রে ধানগাছ থেকে ১.৫ ফুট উচ্চতায় মাঁচা তৈরি করতে হরে।
আইল ফসলের জমি তৌরি, জাত নির্বাচন, বপন বা রোপণ পদ্ধতি ও সময়, সার ও সেচ ব্যবস্থাপনা, অর্ন্তবতীকালীন পরিচর্যা, পোকামাকড় ও রোগবালাই দমন পদ্ধতি এবং ফসল সংগ্রহ সবই মূলজমিতে ঐ ফসল চাষাবাদের অনুরূপ। পানিতে ডুবেনা এমন উঁচু ও চওড়া ধরনের আইলে পাতাজাতীয় সবজী যেমন লালশাক, ডাঁটাশাক, পুঁইশাক, পালংশাক ও কলমিশাক চাষ করা যায় । এসব ফসলের জন্য এক লিটার পানিতে ১০ গ্রাম ইউরিয়া মিশিয়ে তরল আকারে স্প্রে করলে ভাল ফলন পাওয়া যায়। সুনিস্কাশিত উঁচু আইলে ঢেঁড়স, টমেটো, বেগুন, মরিচ, সীম ও বরবটি চাষ করা যায় । তবে এক্ষেত্রে আইলের প্রস্থ কমপক্ষে ৪৫ সেন্টিমিটার হতে হবে । বীজ বা চারা রোপণের ৭-১০ দিন পূর্বে গোবর, টিএসপি ও এমপি সার আইলের মাটির সাথে ভালভাবে মিশিয়ে দিতে হবে । চারা রোপণের ১৫-২০ দিন পর প্রথমবার এবং ৩০-৪০ দিন পর দ্বিতীয়বার ইউরিয়া সার উপরি প্রয়োগ করতে হবে । আইলে মাদা বা হিপ তৌরি করে সেখানে লতাজাতীয় সবজী যেমন মিষ্টিকুমড়া, চালকুমড়া, লাউ, ঝিঙ্গা, করলা, শসা, চিচিঙ্গা, স্কোয়াশ প্রভৃতি চাষ করা যায় । এক্ষেত্রে চারা ১৫-২০ সেমি লম্বা হলে বাঁশের কঞ্চি, ধৈঞ্চার গাছ বা অন্য কোন ডাল দিয়ে বাউনি দিতে হবে । এবং গাছ ৫০ সেমি এর বেশি লম্বা হলে ১.৫ মিটার উঁচু করে মাচা তৌরি করে দিতে হবে । মাচার প্রস্থ ১.৫ মিটারের বেশী না হওয়াই বাঞ্চণীয় । নীচু সরু আইল অথবা মাঝারী নিচু আইলে লতিরাজ জাতীয় পানিকচু চাষ বেশ লাভজনক । শুকনো জমির আইলে বহুমুখী ফসল ভূট্রা, তৈলজাতীয় ফসল সূর্যমুখী এবং ডালজাতীয় ফসল অড়হড় চাষ করা যায় । এসব ফসল জমির প্রাকৃতিক বেড়া হিসাবেও কাজ করে । পর্যাপ্ত সূর্যলোক সমৃদ্ধ উঁচু চওড়া ও সুনিষ্কাশিত আইলে পেঁপে, সজনা প্রভৃতি চাষ করে প্রচুর লাভ করা যায় । ধান ক্ষেতের আইলে ধইঞ্চা চাষ করলে একদিকে যেমন মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি পায় তেমনি অন্যদিকে জ্বালানী হিসাবে ব্যবহার করা যায় । এছাড়াও ধইঞ্চা, অড়হড়, সজনা প্রভৃতি গাছ এবং লতাজাতীয় সবজীর জন্য দেওয়া বাউনি ও মাঁচায় পাথিরা আশ্রয় নিয়ে মুল ফসলের ক্ষতিকর পোকামাকড় খেয়ে ধ্বংস করে থাকে ।
জমির আইলে অল্প পরিশ্রমে ও অল্প খরচে সবজি উৎপাদন করে কৃষকরা তাদের পারিবারিক খাদ্য ও পুষ্টি চাহিদা মিটিয়ে সহজেই অতিরিক্ত আয় করতে পারেন। এছাড়াও আইলের উৎপাদিত সবজি আত্মীয় -স্বজন ও পাড়া-প্রতিবেশীদের মধ্যে বিতরণ করে সামাজিক বন্ধন সংহত করা যায়। বন্যা পরবর্তী বোরো মৌসুমে ধানী জমির আইলে শাক-সবজি চাষ করে অধিক লাভবান হওয়া সম্ভব যা বন্যার ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে কৃষকদের সহায়তা করবে। আর এভাবেই আইল ফসল চাষাবাদের মাধ্যমে বাংলাদেশের প্রচলিত চাষাবাদ ব্যবস্থায় জমিতে আইলের আধিক্য অভিশাপ থেকে আশির্বাদে পরিণত হতে পারে।
লেখকঃ প্রাক্তন চেয়ারম্যান, প্লান্ট প্যাথলজি বিভাগ, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়।