তালহা হাসান, হাবিপ্রবি প্রতিনিধি: সৈয়দা তাহমিদা মারজান পড়াশোনা করেন দিনাজপুরের হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (হাবিপ্রবি) কৃষি অনুষদে। নিয়মিত পড়াশোনার পাশাপাশি ফেসবুক পেজ ‘প্রাঙ্গণ’ এর মাধ্যমে নিজের হাতে ডিজাইন করে সেলাই করা শাড়ি,পান্জাবি,বোরকাসহ কাস্টমাইজড চাবির রিং বিক্রি করে সাড়া ফেলেছেন এই শিক্ষার্থী।
২০২০ সালে করোনাকালীন সময়ে নিতান্তই শখের বসে রংপুরে নিজেদের বাসার বাগানের গাছ বিক্রি করা শুরু করেন মারজান। শখের বসে গাছ বিক্রি করলেও সেখান থেকে পাঁচ দিনে প্রায় পাঁচ হাজার টাকার মতো লাভ করেন তিনি। কিন্তু বাসা থেকে নিষেধ করার পর সেবার আর বেশিদূর এগোতে পারেননি। তবে একান্তই শখের বসে গাছ বিক্রি শুরু করলেও পরে তিনি বুঝতে পারেন নিজহাতে কোনকিছু তৈরি করে সেটা মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে তার ভালো লাগে। নিজের ওপর আত্মবিশ্বাস তৈরি হয় যে, চাইলে তিনি ছোটখাটো শখের কাজ করে নিজের শখ পূরণের পাশাপাশি বাড়তি অর্থও উপার্জন করতে পারবেন। এরপর করোনা শেষে ভর্তি পরীক্ষা শুরু হলে সেই সময়টায় তেমনকিছু করতে পারেননি তিনি।
২০২২ সালের মার্চ মাসে গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষার মাধ্যমে হাবিপ্রবির কৃষি অনুষদে ভর্তি হন তিনি। ভর্তি হওয়ার পরই পুরনো শখ আবার মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে তার মধ্যে। কিন্তু ক্যাম্পাসে চলে আসায় নিজের বাগানের গাছ বিক্রি করা তার পক্ষে আর সম্ভব ছিলোনা। তিনি চিন্তা করেন নতুন কিছু করার। পরিকল্পনা করেন দীর্ঘমেয়াদি কিছুর। সেকারণে অনলাইন নির্ভর কিছু করার চিন্তা তার মাথায় আসে। ইদের সময় হওয়ায় পাশাপাশি নিজেও সেলাইয়ের কাজ জানায় অনলাইনে পাঞ্জাবিতে কাস্টমাইজড হ্যান্ড পেইন্ট আর সেলাই এর পরিকল্পনা করেন। এরপর নিজেই কিছু পাঞ্জাবি সংগ্রহ করে সেগুলো ফেসবুকে আপলোড করেন। কয়েকদিনেই নিজের বন্ধুবান্ধব, সিনিয়র-জুনিয়রের থেকে ভালো সাড়া পান। এতে করে আত্মবিশ্বাস আরও বেড়ে যায় তার। ঠিক করেন এই কাজ নিয়েই এগিয়ে যাবেন। ভালো সাড়া পেয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে শুধুমাত্র নিজের হাতে পেইন্টিং ও সেলাই করা কাপড় বিক্রির জন্য ‘প্রাঙ্গণ’ নামে একটা ফেসবুক পেজ খুলে ফেলেন। এরপর এই পেজেই অর্ডার নেওয়া শুরু করেন। পরবর্তীতে শুধুমাত্র পাঞ্জাবির কাজ করা থেকে সরে আসেন তিনি। শুরু করেন কাস্টমাইজড চাবির রিং, হাতের কাজের বোরকা, হাতের কাজের শাড়ির অর্ডার নেওয়া। শাড়ি,পাঞ্জাবিতে হ্যান্ড পেইন্ট এর পাশাপাশি বিভিন্ন নকশার সেলাই করেও ক্রেতাদের সরবরাহ করছেন তিনি।
এ বিষয়ে মারজান বলেন, “ভার্সিটিতে ভর্তির পর কিভাবে কি বিজনেস শুরু করব এইসব ভাবছিলাম। ২০২৩ সালে রমজানের আগে হঠাৎ মাথায় আসে আমি সুই সুতায় সেলাই এর কাজ পারি। সেবার ইদ টার্গেট রেখে কিছু পাঞ্জাবি এনে আর গুগল থেকে কিছু ছবি নিয়ে স্টোরি দেয়া শুরু করি। আলহামদুলিল্লাহ অভাবনীয় সারা পাই। হ্যান্ড পেইন্ট পাঞ্জাবীর অনেক অর্ডার আসে,তখন হ্যান্ড পেইন্টে অনেক ল্যাকিংস ছিলো। কিন্তু হ্যান্ড পেইন্ট করা সহজ ছিলো সেলাই এর চেয়ে। হাতে সেলাই করতে প্রচুর সময় লাগতো। অনেকেই পরামর্শ দিয়েছিলো হ্যান্ড পেইন্ট কন্টিনিউ করতে। কিন্তু আমি সেলাইয়ের কাজ বেশিই উপভোগ করি।”
তিনি আরো বলেন, “আমার ক্রেতা, যারা সেলাই চিনে তাদের কম্পলিমেন্টে নতুন করে ভরসা করে হাতে করা সেলাইয়ের কাজ নিয়ে আগানো শুরু করি। এরপর ধীরে ধীরে হ্যান্ড এম্ব্রয়ডারি চাবির রিং, হাতের কাজের বোরকা, হাতের কাজের শাড়ি নতুন সংযোজন করি।”
তবে কাপড় বিক্রি করার এই শখ পূরণ করতে গেলে শুধু নিজের দক্ষতা থাকলেই হয়না এজন্য ভালো গুণগত মানের কাপড়ও প্রয়োজন। এজন্য অনেক সময় পছন্দের কাপড় সংগ্রহের জন্য বেশ বিড়ম্বনায়ও পড়তে হয় তাকে। কাপড় কেনা থেকে শুরু করে ক্রেতা পর্যন্ত পৌছাতে সবকিছু করেন নিজের জমানো টাকা দিয়েই। শখ থাকলে যে যেকোন সমস্যা কাটিয়ে উঠা যায় সেটা প্রকাশ পায় তার কণ্ঠেই।
তিনি বলেন, “হাতে সেলাই বা পেইন্টিং এর প্রয়োজনীয় কাপড় এর জন্যে আমাকে অনেকটা পরিশ্রম করতে হয়,কোনোটা রংপুরেই পাই তো কোনোটা বাহিরে থেকে ইম্পোর্ট করতে হয়, কোনোটা ঢাকায়,কোনোটা কুমিল্লা থেকে কুরিয়ার করে নিয়ে আসি। এখন হাতের কাজের পাশাপাশি হ্যান্ড পেইন্টও করছি। পুরোটা সময় একাই কাজ করেছি।
আমার জমানো টাকা থেকেই ইনভেস্ট করি, ইনভেস্ট এর জন্য কখনোই পরিবারের থেকে কিছু নিই নি। এটা সম্পুর্ণ আমার ব্যক্তিগত স্বপ্ন, তাই স্বপ্ন পূরণের চেষ্টাও একান্তই আমার।”
তিনি নিজে যেহেতু একজন শিক্ষার্থী তাই নিজেও শিক্ষার্থীদের চাহিদা বোঝেন। সেটা মাথায় রেখেই কাজ করার চেষ্টা করেন বলে জানান তিনি।বলেন, “আমার কাজের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে সাশ্রয়ী মূল্য। সমসাময়িক যারা হাতের কাজ করেন,হাতের কাজ যেহেতু অনেক সময় সাপেক্ষ তাই দাম ও স্টুডেন্টদের ধরাছোঁয়ার বাইরে। আমি চেষ্টা করি নূন্যতম প্রফিটে স্টুডেন্ট বাজেটে কাজ করার।”
পড়াশোনার চাপ সামলিয়ে এতকিছু কিভাবে করেন। এর উত্তরে তিনি বলেন, “অর্ডারের কাজ আসলে পড়াশোনার মাঝে থেকেও সময় বের করে কাজ করে ফেলি। কারণ সবসময় তো পড়াশোনা করা হয় না। পরীক্ষার সময় ও দেখা যায় শেষ বিকেলে পড়াশোনা হয় না, কিংবা পড়াশোনায় বিরক্ত লাগলে রিল্যাক্সের জন্যেও কাজ করি। এটা মূলত আমার শখ তাই কোন বিরক্ত লাগেনা কখনও।”
এখন শখের বসে এই কাজ করলেও ভবিষ্যতে তিনি শুধুমাত্র শখের মধ্যে আটকে থাকতে চান না। পড়াশোনা করে গতানুগতিক চাকরি করার ধারা থেকে বেরিয়ে এসে নিজেই কিছু করতে চান। সেই সাথে মানুষের কর্মসংস্থান তৈরিতেও কাজ করার কথা শোনালেন তিনি।
মারজান বলেন, “আমার কাজ মূলত অনলাইনে হলেও অফলাইনেও অনেকটা আছে। কাস্টমাইজ যে প্রডাক্টের কাজ করছি,ভবিষ্যতে বৃহৎ পরিসরে করতে পারলে অসহায়,বিধবা,দুস্থ মহিলাদের কর্মসংস্থানের ইচ্ছা আছে। আমি এটাকে নিয়ে আরও অনেকদূর এগিয়ে যেতে চাই। আমার স্বপ্ন আমার পেজ প্রাঙ্গন এর মাধ্যমে হাতের কাজকে অনন্য মাত্রায় নিয়ে যাওয়া।”
কৃষি বিভাগের একজন শিক্ষার্থী হিসেবে মারজান ভবিষ্যতে পরিচিতি এবং বৃহৎ পরিসরে কাজ করার সুযোগ পেলে দেশীয় পণ্য এবং বিভিন্ন কৃষিপণ্য নিয়েও কাজ করার স্বপ্ন দেখেন।